বিআইডিএস ব্লগ বিস্তারিত

বাংলাদেশ বীমা শিল্পের সংক্ষিপ্ত ইতিহাস

 20 May 2022

বীমা ব্যবস্থার সুদীর্ঘ ইতিহাস রয়েছে যা আমার লেখা “জীবন বীমা কেন সবার জন্যই দরকারী” বইয়ের বিস্তারিত উল্লেখ করা আছে। এখানে সংক্ষিপ্তভাবে শুধুমাত্র বাংলাদেশ বীমা শিল্পের সংক্ষিপ্ত ইতিহাস তুলে ধরলাম-

বাংলাদেশে বীমা ব্যবস্থার একটি ঘটনাবহুল ইতিহাস রয়েছে। যা প্রায় ১০০ বছরেরও আগে ভারতে ব্রিটিশ শাসনামলে কয়েকটি বীমা কোম্পানি জীবন বীমা ও সাধারণ বীমা উভয় ধরনের ব্যবসায় শুরু করেছিল। ১৯৪৭-১৯৭১ সময়কালে পূর্ব পাকিস্তানে বীমা ব্যবসা ভাল অবস্থায় ছিল। সে সময় মোট ৪৯ টি জীবন ও সাধারণ বীমা কোম্পানি ব্যবসায় পরিচালনা করত। এসব কোম্পানির শাখা ছড়ানো ছিল বিভিন্ন দেশে। এদের মধ্যে ব্রিটিশ, অস্ট্রেলীয়, ভারতীয়, পশ্চিম পাকিস্তানি ও পূর্ব পাকিস্তানি অন্যতম। ১০টি বীমা কোম্পানির সদর দপ্তর পূর্ব পাকিস্তানে, ২৭টির পশ্চিম পাকিস্তানে এবং বাকিগুলির সদর দপ্তর ছিল বিশ্বের নানা দেশে। কয়েকটি ছাড়া বেশির ভাগ কোম্পানিই ছিল সীমিত দায়ের (limited liability) এবং কাজ করত অবাধ প্রতিযোগিতামূলক অর্থনৈতিক পরিবেশে। এগুলির মধ্যে কিছু ছিল বিশেষায়িত কোম্পানি যারা নির্দিষ্ট ধরনের ব্যবসায়ের সঙ্গে জড়িত ছিল, আবার কিছু ছিল যৌথ কোম্পানি যেগুলি একাধিক ধরনের ব্যবসায় নিয়োজিত ছিল।

বাংলাদেশ সরকার ১৯৭২ সালে রাষ্ট্রপতির আদেশ নম্বর ৯৫ দ্বারা বীমা শিল্পকে জাতীয়করণ করে। এই আদেশ বাংলাদেশ বীমা (জাতীয়করণ) আদেশ ১৯৭২ হিসেবে বেশি পরিচিত। এই আদেশবলে প্রতিরক্ষা, ডাক জীবন বীমা এবং বিদেশি জীবন বীমা কোম্পানিসমূহ ব্যতীত এদেশে ব্যবসারত সকল বীমা কোম্পানি ও সংস্থাকে সরকারি খাতের ৫টি কর্পোরেশনের অধীনে ন্যস্ত করা হয়। এগুলি হচ্ছে জাতীয় বীমা কর্পোরেশন, তিস্তা বীমা কর্পোরেশন, কর্ণফুলি বীমা কর্পোরেশন, রূপসা জীবন বীমা কর্পোরেশন এবং সুরমা জীবন বীমা কর্পোরেশন।

জাতীয় বীমা কর্পোরেশন সরাসরি বীমা ব্যবসায়ের সঙ্গে যুক্ত ছিল না। একটি শীর্ষ সংস্থা হিসেবে এটি বীমা কাজে নিয়োজিত অন্যান্য ৪টি কর্পোরেশনের কাজকর্ম তত্ত্বাবধান ও নিয়ন্ত্রণ করত। তিস্তা ও কর্ণফুলি সাধারণ বীমা ব্যবসা করত, রূপসা ও সুরমা জীবন বীমার কাজ করত। সে সময়ে চালুকৃত ৪৯টি বীমা কোম্পানিকে এই ৪টি কর্পোরেশনের সাথে একীভূত করা হয়। পক্ষান্তরে বিশেষায়িত জীবন বীমা কোম্পানি বা মিশ্র (Composite) কোম্পানির জীবনবীমা অংশটুকু রূপসা ও সুরমার সাথে এবং বিশেষায়িত সাধারণ বীমা কোম্পানি বা মিশ্র কোম্পানির সাধারণ বীমা অংশটুকু তিস্তা ও কর্ণফুলির সঙ্গে সংযুক্ত করা হয়। জীবন বীমা ও সাধারণ বীমা কোম্পানির প্রতিটিতে ২টি করে মোট ৪টি বীমাকারী কর্পোরেশন গঠনের পিছনে মূল উদ্দেশ্য ছিল জাতীয়করণকৃত ব্যবস্থার অধীনেও প্রতিযোগিতাকে উৎসাহিত করা। কিন্তু ৪২টি কর্পোরেশন এবং তাদের একটি শীর্ষ প্রতিষ্ঠানের অপ্রয়োজনীয় প্রশাসনিক ব্যয় সীমিত প্রতিযোগিতার মধ্যে প্রাপ্ত সুবিধাকে গুরুত্বহীন করে ফেলে। ফলে ১৯৭৩ সালের ১৪ মে বীমা কর্পোরেশন আইন ১৯৭৩-এর আওতায় বীমা শিল্পে অবকাঠামোগত পরিবর্তন আনা হয়। এই আইনের আওতায় ৫টি কর্পোরেশনের স্থলে ২টি কর্পোরেশন স্থাপন করা হয়। একটি হচ্ছে সাধারণ বীমা ব্যবসায়ের জন্য সাধারণ বীমা কর্পোরেশন এবং অন্যটি জীবন বীমা ব্যবসায়ের জন্য জীবন বীমা কর্পোরেশন।

ডাক জীবন বীমা ও বিদেশি কোম্পানি দ্বারা জীবন বীমা পূর্বের মতোই সক্রিয় থাকে। তবে বাস্তবে, একমাত্র আমেরিকান লাইফ ইন্স্যুরেন্স কোম্পানিই জীবন বীমার ক্ষেত্রে নতুন ব্যবসায় ও সেবার কার্যক্রম অব্যাহত রাখে। বাকি তিনটি কোম্পানি শুধু পাকিস্তান আমলে বীমাকৃত পলিসিগুলির প্রয়োজনীয় সেবা প্রদানের কার্যক্রম চালিয়ে যেতে থাকে।

সাধারণ বীমা ব্যবসায় চালানোর সমুদয় দায়িত্ব পড়ে সাধারণ বীমা কর্পোরেশনের উপর। আর জীবন বীমার দায়িত্ব পালন করে জীবন বীমা কর্পোরেশন। কিন্তু পরিবর্তীকালে অর্থনৈতিক উদারীকরণ নীতির ফলে বীমা শিল্পে অবকাঠামোগত পরিবর্তন সাধন করা হয়। ১৯৮৪ সালে বীমা কর্পোরেশন আইন ১৯৭৩ এর সংশোধনী আনা হয়। এতে সাধারণ বীমা ও জীবন বীমা কর্পোরেশনের পাশাপাশি ব্যক্তি মালিকানাধীন বীমা কোম্পানি পরিচালনার ব্যবস্থা রাখা হয়। বীমা কর্পোরেশন (সংশোধনী) আইন ১৯৮৪, ব্যবসায় পরিচালনা এবং পুনঃবীমা সংক্রান্ত কয়েকটি বিধিনিষেধ সাপেক্ষে ব্যক্তি মালিকানাধীন সাধারণ ও জীবন বীমা কোম্পানি স্থাপনের অনুমতি দেয়। নতুন আইনের আওতায় সরকারি আর্থিক খাতের সাধারণ বীমার সকল ব্যবসায় রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন সাধারণ বীমা কর্পোরেশনের জন্য সংরক্ষিত রাখা হয়। সাধারণ বীমা কর্পোরেশনকে ব্যক্তিমালিকানা খাতের বীমা কোম্পানিগুলির সঙ্গে প্রতিযোগিতা করে বেসরকারি আর্থিক খাতের বীমা ব্যবসা করারও অধিকার দেওয়া হয়। রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন সাধারণ বীমা কর্পোরেশনকে কিছু প্রতিরক্ষা প্রদান এবং একইসাথে বেসরকারি খাতের বীমা কোম্পানিগুলিকে কিছুটা অভিজ্ঞতা অর্জনের সুযোগ প্রদানের জন্য এই নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা হয়। বেসরকারি খাতের বীমা কোম্পানি কর্তৃক পুনঃবীমা ব্যবস্থা সংক্রান্ত আরও একটি বিধিনিষেধ ছিল। আইনে বলা হয়, বেসরকারি খাতের বীমা কোম্পানিসমূহকে তাদের পুনঃবীমা প্রতিরক্ষার ১০০ শতাংশ অবশ্যই সাধারণ বীমা কর্পোরেশন থেকে নিতে হবে এবং তারা পুনঃবীমার জন্য অন্য কোথাও যেতে পারবে না। এ ধরনের নিষেধাজ্ঞার উদ্দেশ্য হচ্ছে পুনঃবীমা প্রিমিয়ামের আকারে যাতে বৈদেশিক মুদ্রা দেশের বাইরে যেতে না পারে এবং যাতে বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ সামর্থ্য অনুযায়ী একটি পুনঃবীমা বাজার গড়ে ওঠে তার পরিবেশ সৃষ্টি করা। এই ব্যবস্থায় সাধারণ বীমা কর্পোরেশনকে একটি পুনঃবীমাকারী প্রতিষ্ঠানে পরিণত করে। অবশ্য পাশাপাশি তাদের সরাসরি বীমা কার্যক্রমও চলতে থাকে। তবে সর্বমোট বাজার ধারণক্ষমতা সংরক্ষণের পর সাধারণ বীমা কর্পোরেশনের অতিরিক্ত অর্থ দেশের বাইরে পুনঃবীমাকরণে অনুমতি দেওয়া হয়।

বেসরকারি খাতের উদ্যোক্তাদের ধারণা এ ধরনের বিধিনিষেধ আরোপ বেসরকারি খাতের প্রবৃদ্ধির জন্য সহায়ক নয়। সংরক্ষণবাদিতা বাধামুক্ত প্রত্যাশিত প্রবৃদ্ধিতে সহায়তা করে না। কারণ, যেহেতু সরকারি খাতের অর্থনীতি সর্বমোট প্রিমিয়াম পরিমাণের ৮০ শতাংশ নিয়ন্ত্রণ করে, বেসরকারি খাতের কোম্পানিগুলির টিকে থাকার জন্য যৎসামান্য ২০ শতাংশ প্রিমিয়াম অবশিষ্ট থাকে। এরপরও সাধারণ বীমা কর্পোরেশনকে বেসরকারি প্রিমিয়াম জমার নগণ্য অংশ (২০ শতাংশ) নিয়ে ব্যবসায় নিয়োজিত বেসরকারি কোম্পানিগুলির সঙ্গে প্রতিযোগিতার অনুমতি দেওয়া হয়।

বেসরকারি বীমা কোম্পানিগুলি উপরিল্লিখিত সীমাবদ্ধতাসমূহ পুরোপুরি তুলে নেওয়ার দাবি উত্থাপন করে যাতে তারা সাধারণ বীমা কর্পোরেশনের সঙ্গে প্রতিযোগিতা করে ব্যক্তি ও সরকারি উভয় খাতের বীমা ব্যবসা করতে পারে এবং তাদের পছন্দমতো পুনঃবীমাকারীর নিকট পুনঃবীমা করতে পারে। এর ফলে বীমা কর্পোরেশন (সংশোধনী) আইন ১৯৯০ জারির মাধ্যমে বিদ্যমান ব্যবস্থায় পরিবর্তন আনা হয়। 

বেসরকারিকরণ নীতির ফলে ১৯৮৫ সাল থেকে বেসরকারি খাতে বেশকিছু বীমা কোম্পানি আত্মপ্রকাশ করেছে। এর ফলে প্রিমিয়াম থেকে লব্ধ অর্থের পরিমাণ উল্লেখযোগ্যভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে। প্রতিযোগিতা, উন্নত সেবা এবং অনাবিষ্কৃত বিস্তৃত ক্ষেত্র থেকে নতুন নতুন ধরনের ব্যবসায় আবিষ্কারের ফলে এই প্রবৃদ্ধি সম্ভব হয়েছে।

বাংলাদেশের বাজারে বর্তমানে ৪৬টি সাধারণ বীমা কোম্পানি ও ৩৫ টি জীবন বীমা কোম্পানি ব্যবসা করছে। এর মধ্যে রাষ্ট্রায়ত্ত জীবন বীমা করপোরেশন ও সাধারণ বীমা করপোরেশন।

“বাংলাদেশ ইনসিওরেন্স একাডেমি” বাংলাদেশ সরকার ১৯৭৩ সালে এটি বীমা বিষয়ে পেশাগত শিক্ষার উন্নয়ন, আয়োজন ও শিক্ষা প্রদান এবং বীমা বিষয়ে গবেষণা করার উদ্দেশ্যে স্থাপন করে। ওয়েবসাইট: www.bia.gov.bd

“বাংলাদেশ ইন্স্যুরেন্স অ্যাসোসিয়েশন” ১৯৮৮ সালের ২৫ মে ১৯১৩ সালের কোম্পানি আইনের আওতায় এটি গঠিত হয় এবং জয়েন্ট স্টক কোম্পানি রেজিস্ট্রারের নিকট নিবন্ধিত হয়। ওয়েবসাইট: www.biabd.org

“বাংলাদেশ ইনস্যুরেন্স ফোরাম” লাইফ ইনস্যুরেন্স ও নন-লাইফ ইনস্যুরেন্স কোম্পানীসমুহের মূখ্য নির্বাহী কর্মকর্তাদের সমন্ময় গঠিত একটি অলাভজনক পেশাজীবী সংগঠন। ফোরামটি বাংলাদেশ সরকারের বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের টিও-০১ অধি শাখা কর্তৃক লাইসেন্স নং০১/২০১৬ ও রেজিস্ট্রার, জয়েন্ট ষ্টক কোম্পানীজ এন্ড ফার্মাস কর্তৃক সার্টিফিকেট অব ইনকর্পোরেশন নং- TO-912/2016 প্রাপ্ত হয়। ওয়েবসাইট: www.bangladeshinsuranceforum.com

“বাংলাদেশ ইন্স্যুরেন্স ডেভেলপমেন্ট সোসাইটি (বিআইডিএস)” দেশের সর্বস্তরের লাইফ ইন্স্যুরেন্স ও নন-লাইফ ইন্স্যুরেন্স কোম্পানীসমুহের কর্মী ও কর্মকর্তাদের সমন্ময়ে গঠিত একটি অলাভজনক বীমা পেশাজীবী সংগঠন। গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের নিবন্ধিত প্রতিষ্ঠান হিসেবে সোসাইটি রেজিস্ট্রেশন ১৮৬০ সালের ২১ নং আইন অনুযায়ী বিআইডিএস সোসাইটি ২১ মার্চ ২০২১ ইং তারিখে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের অধীনে জয়েন্ট ষ্টক কোম্পানীজ এন্ড ফার্মাস কর্তৃক সার্টিফিকেট অব রেজিস্ট্রেশন নং- S-13531/2021 সনদ প্রাপ্ত হয়। ওয়েবসাইট: www.bidssociety.org
 

সর্বশেষ বিআইডিএস ব্লগ