ইসলামী আমলের দ্বিতীয় শতকের প্রথমদিকে আরব মুসলমানরা ভারত, দক্ষিণ পূর্ব এশিয়াসহ বিভিন্ন দেশ ও মহাদেশে তাদের দীর্ঘ বাণিজ্যিক সফরের উদ্যোগ গ্রহণ করে। এসব সফরের প্রকৃতি অনুযায়ী প্রাকৃতিক দুর্যোগ, দস্যুতা, পথ হারিয়ে ফেলা ইত্যাদির ফলে বিভিন্ন ঝুঁকির মধ্যে পড়ত। পারস্পারিক সহযোগিতা ও সহমর্মিতার মূলনীতি প্রয়োগ করে উক্ত ব্যবসায়ীগণ একটি সাধারণ তহবিল গঠন করতেন, তাদের মধ্যকার কেউ যেকোন দুর্ঘটনায় ক্ষতিগ্রস্ত হলে এই তহবিল থেকে তা পুষিয়ে দেয়া হতো।
এর বহু পূর্বে বীমা ব্যবস্থার সূচনা হয়েছে প্রাচীণ আরবদের মধ্যে। আরবদের মধ্যে একটি প্র্রথা প্রচলিত ছিল যাতে কোনো এক গোত্রের কোনো সদস্য অপর গোত্রের কোনো সদস্যকে হত্যা করলে নিহতের উত্তরাধিকারীগণ হত্যাকারীর ঘনিষ্ঠ আত্মীয়দের নিকট থেকে ক্ষতিপূরণ হিসেবে রক্তমূল্য পেতেন। এ ধরণের একটি মামলা মহানবী সা. মীমাংসা করেছেন ‘আবু হুররাইরা রা. থেকে বর্ণিত, তিনি বলেছেন হুজাইলের দুটি মহিলা ঝগড়া করার সময় একজন অপরজনকে পাথর দিয়ে আঘাত করলে সে এবং তার গর্ভে থাকা সন্তান মারা যায়। নিহতের উত্তরাধিকারীগণ মামলাটি মহানবী সা. এর আদালতে নিয়ে আসলেন। মহানবী সা. রায় দিলেন গর্ভস্থ সন্তানের ক্ষতিপূরণ হবে একটি ক্রীতদাস বা একটি ক্রীতদাসী। আর নিহত মহিলার ক্ষতিপূরণ হিসেবে রক্তমূল্য (দিয়াত) প্রদান করবে ঘাতকের ‘আকিলা’ (পিতার পক্ষের আত্মীয়গণ) ।
দ্বিতীয় খলিফা হযরত ওমর রা. এর আমলে ‘আকিলা’ পদ্ধতি অনুশীলনে জনগণকে উৎসাহিত করতে দেখা যায় সরকারকে। ওমর রা. নির্দেশ দিয়েছিলেন, বিভিন্ন জেলায় মুজাহিদিনদের ‘দিওয়ান’ প্রতিষ্ঠা করতে এবং তাতে তাদের নাম লিখতে বলেছিলেন। ‘দিওয়ানে’ অন্তর্ভুক্ত সদদস্যদের তাদের নিজস্ব গোত্রের কেউ মানুষ হত্যা করলে সবাইকে পারস্পারিক আন্তরিক সহায়তার নির্দেশ দিয়েছিলেন। তাই, ইসলামের দ্বিতীয় খলিফার সময় ‘আকিলা’ পদ্ধতিটি আরো বিকশিত হয়েছে।
ঊনবিংশ শহকে হানাফি আইনপ্রণেতা ইবনে আবিদিন (১৭৮৪-১৮৩৬) প্রথম ইসলামের দৃষ্টিতে বীমার ধারণা ও এর আইনগত অবস্থা নিয়ে আলোচনা করেন। তিনি বীমার আইনগত দিক ব্যাখ্যা করেন। বিংশ শতকে সুপরিচিত ইসলামী আইন প্রণেতা মোহাম্মদ আবদুহ বীমা লেনদেন আল মুদারাবা আর্থিক পদ্ধতির অনুরূপ বলে অভিহিত করেন।
বিশ শতকে শরীয়ার আলোকে বীমা ব্যবস্থার গ্রহণযোগ্যতা নিয়ে অনেক আলোচনা হলেও ইসলামী ব্যাংক ব্যবস্থা চালুর পরেই ইসলামী বীমা বাস্তবে রূপ লাভ করে। দুবাই ইসলামিক ব্যাংক এবং ইসলামিক উন্নয়ন ব্যাংক প্রতিষ্ঠার উদ্যোগ নেন। এই উদ্যোগের অংশ হিসেবে তিনি ১৯৭৬ সালের ফেব্রুয়ারিতে মহামান্য জাফর নিমেরির (তদানিন্তন গণপ্রজাতান্ত্রিক সুদানের প্রেসিডেন্ট) সাথে আলোচনা করেন এবং সুদানে একটি ইসলামী ব্যাংক প্রতিষ্ঠায় তার নিকট থেকে অনুমতি চান। সুদানি সরকারের সকল পর্যায়ের নির্বাহী এবং আইনি কর্তৃপক্ষ এতে খুবই উৎসাহিতবোধ করে এবং প্রস্তাবটি গ্রহণ করে। ১৯৭৭ সালের আগস্টে একটি পাবলিক লিমিটেড কোম্পানি হিসেবে ফয়সাল ইসলামিক ব্যাংকের নিবন্ধন হয়।
ফয়সাল ইসলামিক ব্যাংক প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পর ব্যাংক কর্তৃপক্ষ একটি সমবায় বীমা কোম্পানি প্রতিষ্ঠার ব্যাপারে সমীক্ষা পরিচালনার উদ্যোগ নেয়। এ ব্যাপারে শরীয়াহ সুপারভাইজরি বোর্ডের (এসএসবি) মহামত চাওয়া হয়। ‘এসএসবি’ প্রকল্পটি পর্যালোচনা করে। এসএসবি মহ দেয়, প্রকল্পটি শরীয়াহ’র দৃষ্টিভঙ্গিতে সঠিক এবং একইসাথে বাস্তবতার নিরিখে সম্ভাবনাময়। এ প্রেক্ষাপটে ইসলামিক ইন্স্যুরেন্স কোম্পানি লি. সুদান ১৯৭৯ সালের জানুয়ারি মাসে সুদানি পাবলিক লিমিটেড কোম্পানি হিসেবে (কোম্পানিজ অ্যাক্ট ১৯২৫ এর আওতায়) আত্মপ্রকাশ করে।
ইসলামী শরীয়াহ অনুযায়ী বীমা ব্যবসা পরিচালনার জন্য বর্তমান বিশ্বের এটাই ছিল প্রথম বীমা কোম্পানি। এই কোম্পানির পুরো অনুমোদিত মূলধনের যোগানদাতা ছিল ফয়সাল ইসলামিক ব্যাংক। নব প্রতিষ্ঠিত বীমা কোম্পানিটিকে অনেক ছাড় এবং দায়মুক্ত সুবিধা দেয়া হয়। এর সকল সম্পদ এবং লাভ সকল ধরণের কর থেকে রেহাই দেয়া হয়। অধিকন্তু কোম্পানির সম্পদরাজি বাজেয়াপ্ত, জাতীয়করণ ইত্যাদি বহির্ভূত রাখা হয়। কোম্পানিকে সুদানে বীমা নিয়ন্ত্রণ আইন প্রয়োগ থেকেও অব্যাহতি দেয়া হয়। একই বছর ইসলামিক এ্যারাব ইন্স্যুরেন্স কোম্পানি প্রতিষ্ঠা লাভ করে সউদি আরবে।
মালয়েশিয়ায় প্রাইভেট লিমিটেড কোম্পানি (কোম্পানি আইন ১৯৬৫ এর আওতায়) হিসেবে ১৯৮৪ সালের নভেম্বরে ইসলামিক ইন্স্যুরেন্স কোম্পানি প্রতিষ্ঠিত হয় এবং একটি কম্পোজিট বীমা কোম্পানি হিসেবে ১৯৮৫ সালে আগস্ট থেকে কার্যক্রম শুরু করে। মালয়েশীয় সরকার সেদেশে ইসলামী বীমা প্রতিষ্ঠায় ইতিবাচক পদক্ষেপ হিসেবে ১৯৮২ সালে ‘টাস্কফোর্স’ গঠন করায় এটা সম্ভব হয়। ইসলামী ব্যাংক সংক্রান্ত ন্যাশনাল স্টিয়ারিং কমিটির সুপারিশের ভিত্তিতে টাস্কফোর্স গঠিত হয়েছিল।
মালয়েশীয় সরকারের কাছে প্রদত্ত কমিটির রিপোর্টে ইসলামী বীমা প্রশ্নে বেশ গুরুত্ব দেয়া হয়েছিল। কমিটি মত প্রকাশ করে যে, ইসলামী ব্যাংকের পরিপূরক হিসেবে ইসলামী বীশা ব্যবস্থার প্রয়োজন রয়েছে। টাস্কফোর্সের সদস্যদের মধ্যে ছিলেন ধর্মীয় ব্যক্তিত্ব, আইন বিশেষজ্ঞ, অর্থনৈতিক ও বীমা ব্যবসায়ীবর্গ। টাস্কফোর্সের সদস্যগণ বেশ কয়েকটি ইসলামী দেশ সফর করেন এবং সেই সময়ে প্রতিষ্ঠিত কিংবা প্রতিষ্ঠিত হতে যাচ্ছে এমন তিনটি ইসলামী বীমা কোম্পানির সাথেও আলোচনা করেন। পরিশেষে সরকারের কাছে প্রদত্ত রিপোর্টে টাস্কফোর্স সুপারিশ করে, যত দ্রুত সম্ভব মালয়েশিয়ায় একটি ইসলামী বীমা কোম্পানি প্রতিষ্ঠিত হওয়া উচিত।
মালয়েশিয়া সরকার তখন মালয়েশিয়ায় ইসলামী বীমা (তাকাফুল) নিয়ন্ত্রণের জন্য ‘তাকাফুল অ্যাক্ট’ শিরোনামে আইন জারি করে। এটা উল্লেখ করা যায়, মালয়েশিয়ার ইসলামী বীমা কোম্পানিটি (শারিকত তাকাফুল মালয়েশিয়া নামে যা পরিচিত) বাস্তবে ব্যাংক ইসলামিক মালয়েশিয়া বেরহাদের একটি অঙ্গ প্রতিষ্ঠান এবং ৫১% পরিশোধিত মূলধনের মালিক। বাকি ৪৯% শেয়ার মালয়েশিয়ার বিভিন্ন রাষ্ট্রীয়, ধর্মীয় কাউন্সিল এবং রাষ্ট্রীয় ধর্মীয় ফাউন্ডেশনের। মালয়েশিয়ার তাকাফুল চালুর পর দক্ষিণ পূর্ব এশিয়ার অন্যান্য দেশেও ইসলামী বীমার ক্রম বিস্তৃতি ঘটতে থাকে। বর্তমানে বিশ্বের পায় দুইশত বীমা প্রতিষ্ঠান ইসলামি বীমা ব্যবস্থা চালু করেছে। বাংলাদেশে ইসলামী বীমা বিগত এক দশকে অপ্রতিরোধ্য গতিতে এগিয়েছে এবং অতীব সম্ভাবনাময় বীমা খাত হিসেবে চিহ্নিত হয়েছে।
এম,এমম,ফুরকান