বিআইডিএস ব্লগ বিস্তারিত

বাংলাদেশে প্রচলিত ইসলামী বীমা: সমস্যা ও প্রতিকার

 12 Jan 2022

বর্তমান বিশ্বে ইসলামী অর্থনীতির চাহিদা ও চর্চা দিন দিন বেড়েই চলেছে। আইএফএসবির ২০২০-এর বার্ষিক প্রতিবেদন অনুযায়ী বর্তমান (২০১৯) সময়ে ইসলামী ফিন্যান্স সার্ভিসেস ইনস্টিটিউশনসের প্রধান তিনটি বিভাগের (ব্যাংক, ক্যাপিটাল মার্কেট ও তাকাফুল) মোট সম্পদ প্রায় ২ দশমিক ৪৪ ট্রিলিয়ন মার্কিন ডলার।

এর মধ্যে তাকাফুল কনট্রিবিউশনসের পরিমাণ (২০১৮ শেষে) ২৭ দশমিক শূন্য ৭ বিলিয়ন ডলার, যা বৈশ্বিক ইসলামিক অর্থনৈতিক প্রতিষ্ঠানগুলোর মোট অ্যাসেটের ১ দশমিক ১ শতাংশ। অন্যদিকে তাকাফুল তথা ইসলামী বীমার প্রবৃদ্ধির হার গত ২০১১-১৮ পর্যন্ত ছিল ৮ দশমিক ৫ শতাংশ। বর্তমান বিশ্বের ৩৩টি দেশে তাকাফুল কোম্পানির সংখ্যা পূর্ণ ও উইনসহ মোট ৩৫৩টি (ISLAMIC FINANCIAL SERVICES INDUSTRY STABILITY REPORT 2020, P. 12)

ইসলামী বীমা অগ্রগতির এ ধারাবাহিকতায় বাংলাদেশও বেশ অগ্রসর। বাংলাদেশে ১৯৯৯ সাল থেকে প্রথমবার ইসলামী বীমার কার্যক্রম শুরু হয়। বাংলাদেশে পূর্ণ ও উইন্ডোসহ মোট বীমা কোম্পানির সংখ্যা ৭৬। তার মধ্যে ইসলামী বীমার সংখ্যা ২৬টি। তিনটি নন-লাইফ পূর্ণাঙ্গ ইসলামী বীমা কোম্পানি, আটটি লাইফ পূর্ণাঙ্গ ইসলামী বীমা কোম্পানি ও ১৫টি লাইফ ইসলামী বীমা উইং ইসলামী বীমা ব্যবসা পরিচালনা করছে। দিন দিন সংখ্যার বিচারে ইসলামী বীমা শিল্প বাংলাদেশে বেশ অগ্রসর। অল্প সময়ে তাকাফুলের এই অগ্রযাত্রা উৎসাহব্যঞ্জক।

ইসলামী তথা তাকাফুল বীমায় ২০১৮ সালে প্রিমিয়াম সংগ্রহের পরিমাণ ১ হাজার ৫২ কোটি ২ লাখ টাকা, যা বছরটিতে সংগৃহীত মোট প্রিমিয়ামের ১২ শতাংশ। এর আগে ২০১৭ সালে তাকাফুল বীমায় মোট প্রিমিয়াম সংগ্রহ ছিল ৯৪৫ কোটি ৪৭ লাখ টাকা, যা বছরটিতে সংগৃহীত মোট প্রিমিয়ামের ১২ শতাংশ ছিল। তুলনামূলকভাবে ২০১৮ সালে তাকাফুল বীমার প্রিমিয়াম আয়ে ১১ শতাংশ প্রবৃদ্ধি হয়েছে (ইন্স্যুরেন্স নিউজ বিডি, ১৮/১০/২০১৯)

বাংলাদেশে ইসলামী বীমার ওই অগ্রযাত্রা আশাজাগানিয়া হলেও ইসলামী বীমা কোম্পানিগুলোর শরিয়াহ পরিপালনের বিষয়টি দুশ্চিন্তার কারণ। কারণ কোম্পানিগুলোর শরিয়াহ গুণগত মানে কতটুকু অগ্রসর হচ্ছে, তার কোনো ডকুমেন্ট খুঁজে পাওয়া যায় না। অনুসন্ধানে বরং ভিন্ন চিত্র দেখা যায়। ইসলামী বীমার ক্ষেত্রে আন্তর্জাতিক শরিয়াহ কোনো স্ট্যান্ডার্ড ও গভর্ন্যান্সও অনুসৃত হয় না। আমরা মনে করি, শরিয়াহ সম্পর্কে আলোচনা-পর্যালোচনা শরিয়াহ প্রতিপালনের ক্ষেত্রে ইসলামী বীমা কোম্পানিগুলোর কিছুটা হলেও সহায়ক হবে ইনশা আল্লাহ।

তাই তাকাফুল তথা ইসলামী বীমা কোম্পানিগুলোর শরিয়াহর দিক উন্নয়নের স্বার্থে এখানে ধারাবাহিকভাবে এ বিষয়ে কিছু সমস্যা ও তার সম্ভাব্য কিছু প্রতিকার সম্পর্কে গঠনমূলক কিঞ্চিৎ আলোকপাত করা হলো—

১. ইসলামী বীমাসংক্রান্ত আইন: বাংলাদেশে বীমা প্রতিষ্ঠা, পরিচালনা ও নিয়ন্ত্রণের জন্য আইন আছে। ১৯৩৮ সালের বীমা আইন, ১৯৫৮ সালের বীমা বিধিমালা ও ১৯৭৩ সালের বীমা করপোরেশন আইন দ্বারা বীমা ব্যবসা নিয়ন্ত্রিত হয়। কিন্তু এর একটিও ইসলামী বীমার জন্য করা হয়নি। ইসলামী বীমার অনেক নীতি ও পদ্ধতি এসব আইনের সঙ্গে সাংঘর্ষিক।

মাত্র কিছুদিন আগে সর্বশেষ বীমা আইন, ২০১০-এর ১৮ মার্চে একটি গেজেটের মাধ্যমে ইসলামী বীমা ব্যবসাকে শুধু অনুমোদন দেয়া হয়। এর আগ পর্যন্ত ১০ বছরের মতো কেবল মন্ত্রিসভার অনুমোদনে ইসলামী বীমা ব্যবসা পরিচালিত হয়েছে। আর নিবন্ধিত হতো ইন্স্যুরেন্স অ্যাক্ট, ১৯৩৮-এর অধীনে। ওই গেজেটে ইসলামী বীমা ব্যবসার কেবল অনুমোদন দেয়া হয়েছে। তাতে বিস্তারিত কোনো নির্দেশনা নেই (গেজেটের পূর্ণ ভাষ্য দেখুন ইসলামী বীমা: প্রেক্ষিত বাংলাদেশ, পৃ. ১৭), অথচ ইসলামী বীমাকে বাস্তব অর্থে ইসলামীকরণের জন্য স্বতন্ত্র আইনের বিশদ রূপরেখা ছাড়া সম্ভব নয়। যদি তা না হয় তাহলে দুটি সমস্যা অনিবার্যভাবে দেখা দেবে। যথা:

ক. পুরোপুরি ইসলামীকরণ সম্ভব হবে না। পদে পদে শরিয়াহ বাস্তবায়নে বাধার সম্মুখীন হবে। বর্তমানে হচ্ছেও তা-ই।

খ. ইসলামের নামে সরলমনা মুসলিম জনগোষ্ঠী প্রতারণার শিকার হবে। দুঃখজনক হলেও বাংলাদেশে তাই হচ্ছে। বিস্তারিত বিবরণ সামনে আসছে।

এ দেশে ইসলামী বীমা প্রতিষ্ঠার প্রায় দেড় যুগ পরও স্বতন্ত্র ‘ইসলামী বীমা আইন’ তৈরি হয়নি। অথচ বাংলাদেশের পরে কিছু দেশে ইসলামী বীমা প্রতিষ্ঠা হয়েছে এবং সেখানে তাকাফুলবিষয়ক স্বতন্ত্র আইন রয়েছে। সাধারণত যেটা দেখা যায়, প্রথমে স্বতন্ত্র ইসলামী বীমা আইন তৈরি হয়, এরপর ইসলামী বীমা প্রতিষ্ঠা হয়। যেমন  মালয়েশিয়ায়  ১৯৮৩ সালে ‘তাকাফুল (বীমা) অ্যাক্ট ১৯৮৪’ পাস হয়। এরপর ওই বছর ২৯ নভেম্বর প্রথম প্রতিষ্ঠা হয় ‘শারিকাতুত তাকাফুল সেন্ডিরিয়ান বারহাদ লি.’। পাকিস্তানে ২০০৫ সালে তাকাফুল রুলস জারি হয়। এরপর সেখানে তাকাফুল কোম্পানি প্রতিষ্ঠা হয়। এটি শুধু বাংলাদেশের ইসলামী বীমার চিত্র নয়; এ দেশে ইসলামী ব্যাংকিংয়ের চিত্রও অভিন্ন। সব চলে সুদি ও জেনারেল আইনের আওতায়। মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ দেশে এটি খুবই দুঃখজনক।

প্রতিকার: উল্লিখিত সমস্যা থেকে উত্তরণের একমাত্র পথ তাকাফুলবিষয়ক স্বতন্ত্র আইন রচনা করা। ২৬টি ইসলামী বীমা ব্যবসায়িক কর্তৃপক্ষদের একযোগে এজন্য সরকারের কাছে জোরালো দাবি জানানো জরুরি। এ-সংক্রান্ত বিধি ও প্রবিধানমালা গেজেট আকারে দ্রুত প্রকাশ করার উদ্যোগ যেন নেয়া হয়, এজন্য জোরালো অবস্থান গ্রহণ করা উচিত। আর সরকার যেহেতু নীতিগতভাবে একে অনুমোদন দিয়েছে, তাই এ-সংক্রান্ত বিস্তারিত বিধিবিধানও অনুমোদন করা উচিত যেন জনগণ প্রতারিত না হয়।

২. ইসলামী বীমার সঠিক ও বিশদ রূপরেখা: ইসলামী বীমা পরিচালনার আগে এটি নিশ্চিত করা জরুরি যে সেটা কোন মডেলে পরিচালিত হবে, তাবররু না ওয়াকফ মডেলে। দুটি মডেলের রূপরেখা স্বতন্ত্র। দুঃখের বিষয় হলো, আমাদের দেশে ইসলামী বীমা শিল্পে শরিয়াহর উন্নতি না হওয়ার একটি বড় কারণ হলো, ইসলামী বীমার শরিয়াহসম্মত কোনো মডেল বা রূপরেখা আমাদের দেশে ইসলামী ব্যাংকিংয়ের মতো সুস্পষ্ট হয়ে ওঠেনি। বাংলায় মৌলিক এমন একটি বই পাওয়া যায় না, যাতে বাংলাদেশে প্রচলিত ইসলামী বীমার শরিয়াহসম্মত রূপরেখা নিয়ে থিওরিক্যাল ও প্র্যাকটিক্যাল আলোচনা করা হয়েছে। এমনকি সরেজমিনে ইসলামী বীমার বিভিন্ন ব্রাঞ্চে ভিজিট করে এবং ব্রাঞ্চ-প্রধানের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, তাদের অনেকে ইসলামী বীমার কোনো মডেল আছে বলেও জানেন না।

আফসোসের বিষয় হলো, সেন্ট্রাল শরিয়াহ কাউন্সিল ফর ইসলামিক ইন্স্যুরেন্সের পক্ষ থেকে ২০১৬ সালে ৩৬৮ পৃষ্ঠার একটি বই প্রকাশ হয় ‘ইসলামী বীমা: প্রেক্ষিত বাংলাদেশ’ নামে। তাতে মোট ১৭টি প্রবন্ধ স্থান পেয়েছে। অথচ মাত্র একটি প্রবন্ধে ইসলামী বীমার শরিয়াহ রূপরেখা বা মডেল নিয়ে কিছুটা আলোচনা করা হয়েছে। তাও বেশ সংক্ষিপ্ত এবং মীমাংসাহীন। প্রবন্ধকার সুনির্দিষ্ট কোনো ফলাফলে উপনীত হননি। সব শেষে এমন একটি বিষয় উল্লেখ করে তিনি প্রবন্ধের ইতি টেনেছেন, যা বিচ্ছিন্ন ও অগ্রহণযোগ্য বক্তব্য। তা হলো, ইসলামী বীমা মূলত এমন একটি চুক্তি, যা তাবাররু ও মু’আওদা (বিনিময় চুক্তি) উভয়ের মিশ্রিত রূপ। 

বইটির নামে যদিও লেখা আছে ‘প্রেক্ষিত বাংলাদেশ’, কিন্তু বাস্তবে বাংলাদেশে ইসলামী বীমা ব্যবস্থা কোন মডেলে পরিচালিত হয়, এর রূপরেখা কী, ওই মডেল বেছে নেয়ার যৌক্তিকতা কী—এসব কিছুই তাতে স্থান পায়নি। অধিকাংশ প্রবন্ধ অনেক আগের লেখা।  ১৯৮৩ সালে প্রকাশিত মাওলানা আব্দুর রহীম সাহেবের প্রবন্ধও তাতে স্থান পেয়েছে। যদ্দরুন ইসলামী বীমার ফিলহাল অবস্থা ফুটে ওঠেনি।

প্রতিকার: অনতিবিলম্বে বাংলাদেশের পরিপ্রেক্ষিতে ইসলামী বীমার রূপরেখা ও মডেল নিয়ে ফিকহি কনফারেন্সের আয়োজন করা এবং এ বিষয়ে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা দরকার। এরপর সিদ্ধান্তকৃত মডেলের বিস্তারিত রূপরেখা নিয়ে গবেষণাধর্মী বই রচনা করা প্রয়োজন। পাকিস্তানে ২০০২ সালে ইসলামী বীমা মডেল নিয়ে আন্তর্জাতিক কনফারেন্স হয় এবং তাতে ওয়াকফ মডেলের ওপর ইসলামী বীমা পরিচালনার সিদ্ধান্ত হয়। এরপর এ বিষয়ে স্বতন্ত্র বই রচনা করা হয়েছে এবং সেই ভিত্তিতে তাকাফুল কোম্পানি প্রতিষ্ঠা হয়েছে। পাকিস্তানে যা হয়েছে, সেটা আমরা এখনো করতে পারছি না।

৩. ইসলামিক ম্যান পাওয়ার: বীমা উন্নয়ন ও নিয়ন্ত্রণ কর্তৃপক্ষের ২০১৭-১৮ বার্ষিক প্রতিবেদন অনুযায়ী শুধু লাইফ ইন্স্যুরেন্স কোম্পানিগুলোর এজেন্টের সংখ্যা (২০১৭ সালে) ৩ লাখ ৮১ হাজার ৮৩৯ জন এবং এমপ্লয়ারের সংখ্যা ২ লাখ ৯ হাজার ৮২৪ জন। আর বীমার আওতাভুক্ত জনসংখ্যা ১ কোটি ৭০ লাখ এবং ৪৯২টি উপজেলায় ৩২টি লাইফ ইন্স্যুরেন্স কোম্পানির মোট অফিস রয়েছে ৬ হাজার ৫৫১টি। যেগুলোর মাধ্যমে সব নাগরিককে বীমার আওতাভুক্ত করার কাজ করে যাচ্ছে। এর মধ্য থেকে ইসলামী বীমা কোম্পানিগুলোর সঙ্গে সংশ্লিষ্ট জনবল সংখ্যা আলাদা করে বলা না হলেও তার একটি ধারণা পাওয়া যায়। অথচ এই বিশাল জনবলকে ইসলামী বীমা সম্পর্কে প্রশিক্ষিত করার কোনো উদ্যোগ বা পরিকল্পনা দেখা যায় না।

ইসলামী বীমা শিল্পকে বাস্তব অর্থে ইসলামীকরণ করতে হলে ‘ইসলামিক ম্যান পাওয়ার’-এর বিকল্প নেই। দক্ষ জনবল ছাড়া কোনো কার্যই সিদ্ধ হয় না। এটি স্বীকার করতেই হবে, ইসলামী বীমা ব্যবস্থা পরিচালনার জন্য বর্তমানে এ দেশে পর্যাপ্ত প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত ও অভিজ্ঞ জনশক্তি নেই।

প্রতিকার: অনতিবিলম্বে ইসলামী বীমা শিল্পের স্বার্থে ইসলামিক ম্যান পাওয়ার ডেভেলপের জন্য উদ্যোগ গ্রহণ করতে হবে। এক্ষেত্রে অন্যদের পাশাপাশি গুণগত মানসম্পন্ন ফতোয়া বিভাগ থেকে পাস করা তরুণ আলেম ও মুফতিদের কাজে লাগানো যেতে পারে। কারণ তারা শরিয়াহকে যতটা গভীরভাবে বুঝবেন এবং এর প্রতি আন্তরিক হবেন, স্বভাবতই সেটা অন্যদের থেকে আশা করা যায় না।

তাছাড়া আমাদের দেশে এরই মধ্যে ইসলামী বীমা সম্পর্কে বিভিন্ন আলোচনা, ওয়ার্কশপ ও ট্রেনিং হচ্ছে। আইএফএ কনসালট্যান্সি সার্টিফিকেট কোর্স ইন তাকাফুল নামে ইসলামী বীমার ওপর একাডেমিক কোর্সও পরিচালনা করছে। এ ধরনের কোর্সগুলোর মাধ্যমে জনবলকে আরো প্রশিক্ষিত করা প্রয়োজন।

৪. ইসলামী ব্যাংকগুলোর পৃষ্ঠপোষকতা: অন্যান্য দেশে ইসলামী বীমা শিল্প ইসলামী ব্যাংকিং শিল্পের পৃষ্ঠপোষকতায় পরিচালিত হয়। ইসলামী ব্যাংকগুলো ইসলামী বীমাকে অর্থায়ন থেকে শুরু করে সব দিক থেকে সহযোগিতা করে। মালয়েশিয়ায় ইসলামী ইন্স্যুরেন্স কোম্পানির মালিকানা ৮৭ দশমিক ৫ শতাংশ মালয়েশিয়া ইসলামী ব্যাংকের। সেখানে ইসলামী ব্যাংকের ইন্স্যুরেন্স-সংক্রান্ত সব ব্যবসা ইসলামী ইন্স্যুরেন্স পায়। ইসলামী ব্যাংকের হাত ধরে ইসলামী বীমা অগ্রসর হয়। ফলে সেসব দেশে ইসলামী ব্যাংকের ন্যায় ইসলামী বীমাও বেশ অগ্রসর।

কিন্তু বাংলাদেশের চিত্র ভিন্ন। এখানে ইসলামী বীমার ওপর ইসলামী ব্যাংকগুলোর তেমন পৃষ্ঠপোষকতা নেই। এখনো ইসলামী ব্যাংকগুলোর ইন্স্যুরেন্স ব্যবসা ইসলামী ইন্স্যুরেন্সকে দেয়া না-দেয়া ব্যাংক কর্মকর্তাদের ইচ্ছাধীন। তাছাড়া আমাদের দেশে এখনো ইসলামী ব্যাংকিং শিল্প প্রশ্নাতীত নয়। এ দেশে ইসলামী ব্যাংকিংয়ের যাত্রা অর্ধশতাব্দী হতে যাচ্ছে অথচ এখনো ‘ইসলামী ব্যাংক কোম্পানি আইন’ রচিত হয়নি। যদ্দরুন শরিয়াহ বাস্তবায়ন বিভিন্নভাবে বাধার সম্মুখীন হয়। উপরন্তু যোগ হয়েছে ইসলামিক ম্যান পাওয়ারের বিরাট শূন্যতা, ব্যাংকিং নীতি ও প্র্যাকটিসে বড় রকমের তফাত। শরিয়াহর ক্ষেত্রে যার নিজের অবস্থানই এতটা নাজুক ও দুর্বল, সেখানে ইসলামী বীমাকে কীভাবে পৃষ্ঠপোষকতা করবে!

প্রতিকার: ইসলামিক ব্যাংকিং শিল্পকে শরিয়াহ বাস্তবায়নে আরো গুণগত মান অর্জন করতে হবে। একই সঙ্গে ইসলামী বীমার প্রতি আন্তরিক হতে হবে। এটি বাধ্যতামূলক হতে হবে যে ইসলামিক ব্যাংকের সঙ্গে লেনদেন করতে হলে ইন্স্যুরেন্স (যদি করতে হয়) ইসলামী বীমা থেকে করতে হবে। তবেই ইসলামী বীমা শিল্প অন্যান্য দেশের মতো আমাদের দেশেও অগ্রসর হতে পারবে।

৫. বাংলাদেশ ব্যাংকে জামানত রাখা: বাংলাদেশ ব্যাংকে বীমা কোম্পানিকে একটি বড় অংকের জামানত রাখতে হয়। এর ওপর বাংলাদেশ ব্যাংক সুদ প্রদান করে। ইসলামী বীমা যেহেতু সুদকে আয় হিসেবে গ্রহণ করতে পারে না, তাই এটি একটি বড় সমস্যা। এ রকম আরো সমস্যা আছে। এসব সমস্যার মূল কারণ তাকাফুলবিষয়ক স্বতন্ত্র বিধি না থাকা। 

প্রতিকার: ক. তাকাফুলবিষয়ক স্বতন্ত্র আইন পাস করা। খ. বাংলাদেশ ব্যাংক মুদারাবা বন্ড চালু করা। গ. শরিয়াহ কমপ্লায়েন্ট সুকুক ইস্যু করা এবং তাতে ইনভেস্টের সুযোগ দেয়া। ঘ. ইসলামী ব্যাংকে মেয়াদি আমানত রেখে এর রিসিট বাংলাদেশ ব্যাংকে লিয়েন রাখার অনুমতি দেয়ার পরামর্শ দেয়া যেতে পারে। ঙ. ইসলামিক বীমা একান্ত বাধ্য হলে বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে প্রাপ্ত সুদ আয় হিসেবে গণ্য করবে না; বরং ডাউট পেমেন্ট বাবদ গণ্য করে চ্যারিটি ফান্ডে দান করে দেবে। 

৬.  কমিশন বাণিজ্য: প্রচলিত বীমা কোম্পানিগুলো এক অশুভ প্রতিযোগিতায় বীমা ব্যবসা করে। তথাকথিত কমিশনের নামে প্রিমিয়ামের এক বিরাট অংশ ছেড়ে দিতে হয়। এ পরিস্থিতিতে ইসলামী বীমা কোম্পানিগুলো বড় একটি চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন হয়। শুধু ইসলামী বীমা নয়, সাধারণ বীমার জন্যও তা অনৈতিক। এটি বন্ধ হওয়া একান্ত আবশ্যক।

প্রতিকার: সরকার ও সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের উচিত এ ব্যাপারে দ্রুত কার্যকরী ব্যবস্থা গ্রহণ করা। 

৭. বিনিয়োগের সীমাবদ্ধতা: ইসলামী বীমা শিল্পের জন্য একটি বড় সমস্যা হলো, তাদের জন্য ইসলামিক ব্যাংক ছাড়া বিনিয়োগের আর কোনো পথ খোলা নেই। আইনত তারা ইসলামিক ব্যাংকেই বিনিয়োগ করতে বাধ্য। আবার ইসলামিক ব্যাংকগুলোর মুনাফাও প্রশ্নাতীত নয়। শরিয়াহ ভায়োলেশনের অভিযোগ  রয়েছে। সুতরাং অনিবার্যভাবে ইসলামী বীমার মুনাফাও প্রশ্নবিদ্ধ হয়ে যায়।

প্রতিকার: ইসলামী বীমার বিনিয়োগ ক্ষেত্র বিস্তৃত করা প্রয়োজন। ইসলামিক ব্যাংক ছাড়াও নিরাপদ খাতে বিনিয়োগের অনুমোদন দেয়া প্রয়োজন। আর ইসলামিক ব্যাংকেরও উচিত তাদের শরিয়াহ ভায়োলেশন কমিয়ে এনে মুনাফা স্বচ্ছ করা। 

৮. রি-ইন্স্যুরেন্স: এ দেশে ইসলামী তরিকায় রি-তাকাফুল ইন্স্যুরেন্সের ব্যবস্থা নেই। ইসলামী বীমাগুলোকে বাধ্য হয়ে সাধারণ বীমা করপোরেশনে পুনঃবীমা করতে হয়। সাধারণ বীমা করপোরেশন পুনঃবীমা থেকে প্রাপ্ত প্রিমিয়াম সুদভিত্তিক বিভিন্ন খাতে বিনিয়োগ করে। বছর শেষে ওই বিনিয়োগ থেকে প্রাপ্ত একটি অংশ পুনঃবীমা গ্রহণকারী বিভিন্ন কোম্পানির মধ্যে মূল প্রফিট কমিশন হিসেবে বণ্টন করে দেয়। ওই খাত থেকে প্রাপ্ত কমিশনও ইসলামী বীমা কোম্পানি তার আয় হিসেবে নিতে পারে না। এটি একটি বড় সমস্যা।

প্রতিকার: ইসলামী রি-তাকাফুল কোম্পানি প্রতিষ্ঠা করা। এর আগ পর্যন্ত অন্তত এতটুকু করা যে সাধারণ বীমা করপোরেশন ইসলামী বীমা কোম্পানির রি-ইন্স্যুরেন্স থেকে প্রাপ্ত প্রিমিয়াম ইসলামী কোনো ব্যাংকে বিনিয়োগ করবে। আর তা না হলে ইসলামী  বীমাগুলো সাধারণ বীমা করপোরেশন থেকে প্রদত্ত মূল প্রিমিয়ামের অতিরিক্ত গ্রহণ করবে না (AAOIFI শরিয়াহ স্ট্যান্ডার্ড ৪১, ধারা ৭) তবে গ্রহণ করতে একান্ত বাধ্য হলে সেটা সওয়াবের নিয়ত ছাড়া সদকা করে দেবে।

৯. শরিয়াহ কাউন্সিল ও মুরাক্বিবদের ভূমিকা আরো উজ্জ্বল করা

AAOIFI তাদের ২৬ নং শরিয়াহ স্ট্যান্ডার্ডের ৫/৯ ধারায় স্পষ্ট করে বলেছে, ‘ইসলামী বীমা কোম্পানির জন্য একটি শরিয়াহ সুপারভাইজরি বোর্ড থাকতে হবে, যাদের ফতোয়া কোম্পানির জন্য মানা বাধ্যতামূলক হবে।’ বীমাকে ইসলামীকরণের জন্য মজবুত শরিয়াহ কাউন্সিল অত্যাবশ্যক। সাধারণ মুসলিমরা বীমাপত্রের গুণাগুণ পরীক্ষা না করে, ইসলামী বীমা কোম্পানির সঙ্গে আস্থাভাজন আলেমদের সংশ্লিষ্টতা দেখেই পলিসি গ্রহণ করেন। অথচ দুঃখজনকভাবে এ দেশে প্রচলিত ইসলামী বীমাগুলোর শরিয়াহ পর্যবেক্ষণ খুবই দুর্বল।

প্রতিকার: ইসলামী বীমা শিল্পকে শরিয়াহর দৃষ্টিকোণ থেকে গুণগত মানে আরো অগ্রসর করতে হলে মজবুত শরিয়াহ তত্ত্বাবধানের বিকল্প নেই। ইসলামী বীমার কাগজপত্র থেকে শুরু করে বাস্তব অপারেশনের তত্ত্বাবধানে আলিম ও মুরাক্বিবদের ভূমিকা যত বেশি উজ্জ্বল হবে, ইসলামী বীমার প্রসার তত বেশি হবে। তাই প্রয়োজন এ দেশের মূলধারার আলেমদের সঙ্গে মতবিনিময় করা এবং তাদের গঠনমূলক সমালোচনা ও পরামর্শকে গুরুত্ব দেয়া। শরিয়াহ বোর্ডকে সুপারভাইজরি বোর্ডে উন্নীত করা। শরিয়াহ বিষয়ে তাদের পূর্ণক্ষমতা প্রদান করা। তাদের শরিয়াহবিষয়ক সিদ্ধান্তকে বোর্ড অব ডিরেক্টরের সিদ্ধান্তের সমমর্যাদা প্রদান করা।

 
ড. এম কবির হাসান: অধ্যাপক, নিউ অরলিন্স বিশ্ববিদ্যালয়, যুক্তরাষ্ট্র

লুকমান হাসান: সিএসএএ, অ্যাওফি, স্কলার

সর্বশেষ বিআইডিএস ব্লগ

ব্লগার তথ্য

অন্যান্য ব্লগ